সম্পাদকের কলমে--

সম্পাদকের কলমে--তাপসকিরণ রায়:

সম্পাদকীয়, পত্রিকার একটি অভিন্ন অঙ্গ। সাহিত্য জীবনের দর্শন। জীবনের সুখ দুঃখ সবকিছু উঠে আসে এখানে, স্মৃতির ঝাঁপি, প্রেম-বিরহ থেকে নিবেদন পর্যন্ত এখানে প্রতিফলিত হয়। এ সব দর্শন জীবনের ধারাবাহিকতাগুলিকে প্রচন্ডভাবে আলোড়িত করে। বর্তমান সময়ে যে ভয়াবহতার সৃষ্টি হয়েছে তার সবটুকুই করোনা মহামারীর দৌরাত্ম।

সবাই আজ আমরা আতঙ্কিত, বদ্ধ-বন্ধ বন্দীশালায় অনিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাসের মাঝখানে বসে আছি। উদ্বিগ্ন মন নিয়ে লেখা যায় না, যেখানে প্রতিদিন মৃত্যুর ছায়াগুলি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে, সেখানে নিজেকে খুঁজে পেতেও যেন বড় কষ্ট হয়। তবু চলছে সবকিছু, সর্বহারা মানুষটিও সবকিছু ভুলে কখনো ম্লান হেসে ওঠে--হতে পারে তা নিজের অজান্তেই। আসলে মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানই যে প্রাণীর ধর্ম। এই ধ্রুব সত্য মৃত্যুকে কেউ স্বেচ্ছায় বরণ করতে চায় না।

চোখের সামনে সবুজ ঘাস, বসন্তের শিমুল-পলাশ এ সব কিছু পসরার মাঝে আমরা সিঁদুরে মেঘ দেখে আতঙ্কিত হই। কখনো সমস্ত আলো নিভে গেলে অন্ধকারে আঁচড় কেটে আমরা লিখে যাই জীবনের কবিতা।

সমস্ত পথ একই জায়গায় গিয়ে মিশেছে। তবু হাতের কাছে কলম পেলে আমি আমার কথা লিখি, তোমার কথা লিখি, অভ্যাস মত উদ্ধৃত হয়ে যায় সুখ-দুঃখ বিরহের কবিতা। জানি বিয়োগ শেষ কথা নয়। আকাশে বাতাসে অন্তরীক্ষে সহস্র আলোড়নের মাঝে আত্মজনের অন্তর কথা, ব্যথার কথা, আনন্দ-বিরহ-বিয়োগেরকথা গীত হয়ে যায়।

সম্পাদকীয় প্রসঙ্গ লিখতে গিয়ে যেন আজ সব অবান্তর হয়ে পড়েছে। লিখতে লিখতে লেখকের কলম থেমে যাচ্ছে। আবার সে উঠে বসচ্ছে। এই সবই বুঝি প্রদোষকালের লেখা, তালসুরলয়হীন কথা, ছন্দপতনের অপভ্রংশ কথার জোড়াতালি…তবু আমরা লিখব, এই বিদায়ী রাত্রি শেষের হাহুতাশ, শব্দহীনভাষার সঙ্কেত, তবু ধরে নেবো অসুস্থ তাপিত জীবনের প্রলাপ। জনান্তিকে সঙ্গহীন কথা বলে যাব, উন্মাদ উন্মাদনায় খানিক বিহ্বল হেসে নেব, মাতালের মত না হয় অসংযত ব্যথার কথা নিয়ে খানিক কেঁদে নেবো।

কখনো মনে হয়, এই ঘরবেড়ের অন্ধকার ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে এসে দুহাত তুলে চিৎকার দিয়ে বলে উঠি, কোথায় আছো তুমি, হে জীবনদাত্রী, ভাগ্যনিয়ন্ত্রা, তুমি বাঁচাও...আমাদের তুমি বাঁচাও...

সহ সম্পাদক হিসেবে: শমিত কর্মকার--


আমরা আবার একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সবাই ভেবেছিলাম আমরা বোধহয় ঠিকঠাকভাবে চলছি। আবার সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে আগের মতো। আমরা শুরু করেছিলাম সাহিত্য সভা বই প্রকাশ খুব ভালো লাগছিল। যারা সাহিত্য জগতের সাথে যুক্ত তারা এইগুলো চায় লেখার সাথে সাথে। তাই আবার আবার আমাদের সকলকেই ঠিক থাকতে হবে। যতোটা সম্ভব এই এরিয়ে চলতে হবে। আশা রাখি আবার সব ঠিক হবে হবেই।


সহ-সম্পাদকের কলমে--সাবিত্রী দাস--

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই মানুষ তার বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে অন্য প্রাণীদের থেকে নিজেকে আলাদা করতে সমর্থ হলেও গোড়ার দিকে প্রকৃতির শক্তি গুলোকে ভয় পেয়ে নতজানু হয়ে সেই শক্তি গুলোর কাছে অবনত হয়েছে বিনম্র প্রার্থনায়।

ক্রমে সময়ের বিবর্তনে মানুষ আবার এগুলিকে করায়ত্ত ও করতে চেয়েছে, আর সেই শক্তিগুলোকে কাজে লাগিয়ে মানুষ আজ মহা শক্তিধর।

প্রকৃতি কিন্তু কখনোই মেনে নিতে চায়না তার সৃষ্টির উপর অন্যের আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা।

রুষ্ট প্রকৃতি তাই ক্ষুব্ধ হয়ে বারেবারে চরম শোধ নিয়েছে,হেনেছে আঘাত! মানুষ তার কৃতকর্মের জন্যই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক সমগ্র মানবজাতি আজ ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতির সম্মুখে দণ্ডায়মান।

সুস্থ সুন্দর পৃথিবী আজ ভয়ঙ্কর এক অজানা অসুখে পীড়িত। এই পৃথিবী চায় এক অমল আশ্বাস।

মানুষের সঙ্গে মানুষের একটা দূরত্বের ব্যবধান উঠছে ঘনিয়ে। যদিও এই ব্যবধান হয়তো সাময়িক পরিস্থিতির কারণেই তবুও বুকের গভীরে কথাগুলো ছটফটিয়ে মরে, পারস্পরিক ভাব বিনিময় করে হতে চায় ভারমুক্ত। অধীর আগ্রহে ব্যাকুল হয়ে ওঠে প্রকাশের অপেক্ষায়। এরকমই কিছু সুখ দুঃখের সম্ভার নিয়ে সেজে উঠেছে আজকের বর্ণালোকের সংসার।


শুক্রবার, ৭ মে, ২০২১

ঊশ্রী মন্ডল

 


 

সেই দিনের কথা 

ঊশ্রী মন্ডল 

 

                 মামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাওড়ায় এলাম l দূর্গা পূজার জন্য বাস খুব কম চলছে, তাই বাধ্য হয়েই হাওড়ার ফেরিঘাটে এসে বাবুঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম l এখানে এসেও দেখি বাস নেই, অনেক্ষন ধরে আমারই মতো অনেক লোক অপেক্ষা করছে বাসের অপেক্ষায় l একবার ভাবলাম ফিরে যাই মামার বাসায় l কিন্তু হাওড়ার বাসও আসছে না, আবার ফেরীঘাটও বন্ধ হয়ে গেছে ; এখন কি উপায় ? এদিকে বাসের আসার নামগন্ধও নেই l রাত্রি হতে চলল, মনে মনে অস্থির হয়ে পড়েছি ; বাড়িতে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েছে নিশ্চই l 

                   এমন সময় দেখি অপেক্ষারত যাত্রীরা গুটি গুটি পায়ে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে, আমি সম্পূর্ণ একা দাঁড়িয়ে আছি ; ভীষণ ভয় লাগলো আমি ওদের দিকে ছুট লাগলাম, অবশেষে ওদের ধরে ফেললাম  l কতো লাইট, রাস্তায় লোকজন চলাচল করছে বোধহয় ঠাকুর দেখার জন্য, মাঝে মাঝে পুলিশের ভ্যান সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলেছে ; অন্যান্য যাত্রীদের সাথে এ গলি কখনো ঐ গলি কখনো নির্জন কখনো কোলাহলে পূর্ণ স্থান পেরিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম l প্রায় একঘন্টা পার হয়ে গেলো এখনো বাসের নামগন্ধ নেই, চলছিতো চলছি পথ আর শেষ হতে চায় না ;উৎকণ্ঠায় ও ক্লান্তিতে শরীর  অবসন্ন হয়ে পড়তে লাগলো  l 

                                           এক সময় আমি দেখি সম্পূর্ণ একা, অন্যান্য লোকেরা নিজনিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে ; আমি এখন কিভাবে কোনদিক দিয়ে নিজের ঘরে পৌছাবো ভেবেই পাচ্ছিলাম না, ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হতে লাগলো l আমি কোনো উপায় না দেখে একটা  আলো ঝলমলে গলিতে গিয়ে ঢুকে পড়লাম l সামনে দেখি একটা পান সিগারেটের দোকান, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছে ; একটা জলের বোতল কেনার আশায় ঐ দোকানে দাঁড়ালাম l একটা জলের বোতল কিনে নিয়ে একটা মিষ্টি পানের অর্ডার দিলাম, আমি দেখছি আমার আশেপাশের লোকজন আমাকে কেমন লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখছে আর জটলা পাকাচ্ছে ;আমি ভাবছি এ আমি কোন জায়গায় এলাম l

                                           এমন সময় হটাৎ এক বাজখাঁই আওয়াজের এক রমণীর গলার শব্দে চমকে পিছনে ফিরে তাকালাম , দেখলাম এক লম্বা চওড়া ফর্সা রমণী, সর্বাঙ্গে অলংকারে ঢাকা, মুখে পান  চিবিয়ে চলেছে ; আমাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, "এ লেড়কি, একেলা এধার কেয়া কররাহি হো ? সাথ মে কোহি নহি হ্যায় ? " আমি পাতি বাঙালি হিন্দির ছাতারমাথার কিছুই বুঝিনা,তবুও আমার সাধ্য মতো আমার জানা হিন্দিতে আমি বললাম, " মাতাজী, হম মামাবাড়িসে যব হাওড়ায় আয়য়া তব সে পায়দল চলতে চলতে এতো দূর আগয়া, অভিতক বাস নহি মিলা, বুঝতে নহি পাতা হ্যায় ক্যাইসে ঘর জাউ l"

                                                         ঐ মহিলা তখন বলে, " দেখ বেটি, এ মহল্লা সহি নেহী হ্যায় , জ্যাদা টাইম রয়না তেরে লিয়ে আচ্ছা নহি ; জলদি ইধার সে নিকাল চল l"

"এ রহমান ভাইয়া ইতনা কিউ দের কর রহি হো, জলদি ইনকা পান বানাকে দে দো ; " ঐ পানওয়ালা বলে, " হ্যা বহেনজি আভি দে রহি হু | " আমি যেই পানের বদলে পয়সা দিতে গেলাম, তখন ঐ মহিলা বলল, " নহি বেটি পয়সা মত্ দো,এ ভাইয়া মেরে খাতা মে লিখকর রাখো l

আমার হাত ধরে বলল, " চল বেটি তেরেকো ম্যায় খুঁদ বাসস্ট্যান্ড পৌঁছা দেতি হুঁ, মেরে সাথ চল , " বলে প্রায় টানতে টানতে আমাকে নিয়ে চলল  l অবাক হয়ে দেখি প্রায় প্রতি ঘরের দরজায় বিকট মেকাপ করে স্বল্প বসনে মেয়েরা কেমন লাস্য ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, বেটাছেলেগুলো মৌমাছির মতো তাঁদের ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে  ; আমার কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো,  ভাবছি এ কেমন জায়গা, এও কি অবস্থিত কলকাতায় ? 

                                                একসময় ঐ মহিলা আমায় বলল, " লে বেটি, হামলোগ বাসস্টান্ডে আগই |" ঠিক সেই সময় একটা বাস আসতে দেখলাম  l আমি বললাম , মাজী আমার বাস আ গয়া  l" তখন ঐ মহিলা হাত দেখিয়ে ঐ বাসকে দাড় করিয়ে কন্ট্রাক্টারকে বলল, " এ কন্ট্রাক্টার মেরি বেটিয়া কো সহি স্যালামত ইনকা স্টপেজ মে পৌঁছা দে না, ঠিক হ্যায় l"তখন কন্ট্রাক্টর বলল, " চিন্তা মত্ করো দিদি, ম্যায় ঠিক উনকা স্টপেজ মে উতার  দুঙ্গা l" আমি আর দেরী না করে তাড়াতাড়ি ঐ বাসে উঠে বসলাম l জানলা দিয়ে মুখ বার করে বললাম, " ভালো থেকো মাজী, অনেক অনেক ধন্যবাদ l"ঐ মহিলা বলে, "বেটি ভুল কোরকেও কভি ইধার মত্ আনা, মেরা বাত ইয়াদ রাখনা, সুখি রহ l

ইতিমধ্যে বাস ছেড়ে দিলো, আমি এবার আমার গন্তব্যের দিকে রওনা দিলাম l এখন বাসের ভিতরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কেউ নেই, আমি সম্পূর্ণ একা l ড্রাইভার, কন্ট্রাক্টর ও হেলপার কেমন যেন দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে, আমি বেশ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম l

                                  একসময় আমি আমার গন্তব্যে এসে পৌঁছালাম l বাস আমাকে এখানে নামিয়ে চলে গেলো l এখন আমি সম্পূর্ণ একা, চারিদিক অন্ধকার শুনসান l এখান থেকে আমার বাড়ি প্রায় বিশ মিনিটের রাস্তা, ধান ক্ষেতের আঁকাবাঁকা আলের উপর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম l কখনো হোঁচট খেয়ে পরি আবারও উঠি এই ভাবে নিজের ঘরে এসে পৌছালাম l দেখি বাড়ির লোকেরা বাইরে বেড়াচ্ছে আমাকে খুঁজতে এবং থানায় ডায়েরি করতে, আমাকে দেখে ওদের ধরে যেন প্রাণ ফিরে এলো, অজস্র বাক্য বান আমার দিকে তীরের মতো ছুটে এলো ; এতক্ষন কোথায় ছিলি, কি ভাবে এলি ইত্যাদি l ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সময় সাড়ে বারোটার উপর হয়ে গেছে, আমি বললাম আগে একটু বিশ্রাম নিতে দাও তারপর সব বলছি l

                                                               এরপর আমি আমার পরিবারের পরিজনদের আমার আপবিতির কথা বললাম, ওরা শুনে বলে, সর্বনাশ তুইতো সোনাগাছির অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিলি, ঐ মহিলা নিশ্চ্য়ই কোনো কোঠাবাড়ির মালকিন ছিলো, তোর অনেক ভাগ্য ভালো ছিলো , ও তোকে কোঠায় তোলে নি, অত্যন্ত ভালো মানুষ বলে তোকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়েছিলো l হে ভগবান তোমায় অনেক অসীম কৃপায় আমার সন্তান ভালোয়  ভালোয় ঘরে ফিরে এসেছে  , অন্য কোনো লোকের পাল্লায় পড়লে অন্য কোথাও পাচার হয়ে যেতো আর তোকে ফিরে পেতাম না l হে ঈশ্বর ঐ মহিলার মঙ্গল করো এই আবেদন রাখলাম l বাবা বললেন তোর মামার বাড়িতেই ফিরে যাওয়া উচিত ছিলো, তাহলে এতো সমস্যার সৃষ্টি হতো না l আর এইরকম বিপদজনক সিদ্ধান্ত কখনোই নিবি না বলে দিলাম l     

              আজও যখন ঐ দিনের কথা ভাবি ঐ মহিলার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায় l এই সংসারে এমনও লোক আছে ভাবতেই অবাক হয়ে যাই l



 

বৃহস্পতিবার, ৬ মে, ২০২১

কৌস্তুভ দে সরকার


 



 

 
আফটার শক

কৌস্তুভ দে সরকার

 

মন থেকে বাড়ি যেতে চায়না অরুণাভ। খালি বলে, যাবো? যাবো কিনা? ওদিকে ফোনের লাইনে এত ডিস্টার্ব। কথাও শোনা যায়না। ভোট আসলে মনে হয় ওর এরকমই হয়। ওর ফোন ট্যাপ করে। কে বা কারা করে ও বোঝে না। কিন্তু এটা ওর সন্দেহ। সন্দেহের সঙ্গত কারণও আছে। প্রতিবারই ভোটের মাস খানেক আগে থেকে ওর ফোন কলে ডিস্টার্ব শুরু হয়। কেন হবে? যে সামান্য দু টাকার রিপোর্টার ও। তাও বাদ যায়না! যাইহোক। এতক্ষণ ফেসবুকের পোস্টেও ছয়লাপ হয়ে গেছে। এইমাত্র ভূমিকম্প হল। অমুক জায়গায় ভূমিকম্প অনুভূত। 

অরুনাভর খুব রাগ হয় এই শালা বাঙালির উপর। এই একটি জাত। দেখছে সবাই পোস্ট দিচ্ছে। সেই একই বার্তা তাকেও জানাতে হবে। তাই সব শালা বৃহল্লাঙ্গুল লেঙ্গুর তুলে সেই একই পোস্ট দিতে থাকে। ও একটু ভিন্ন ধরণের। হুজুগে নাচে না। ভূমিকম্প হয়েছে তো হয়েছে। এতে এমন কি। মানুষ তাহলে এই একবিংশ শতাব্দীতেও বিজ্ঞানের এত অগ্রগতির যুগেও প্রাকৃতিক শক্তিকে ভয় পায়। যাক। মানুষের এইরকম ভয় পাওয়াই দরকার।

অরুনাভ মনে করে, মানুষ বড় বেপরোয়া বেয়াক্কেলে হয়ে গেছে আজ। কোনো কিছুই মানুষকে দমাতে পারছে না। সেখানে এই রকম কিছু হলে শালারা একটু যদি টাইট হয়। হোক। মাঝেমধ্যেই ভূমিকম্প হোক। তাহলে যদি শিক্ষা পায় মানুষ। আর শিক্ষা। এতবড় একটা মারী যাচ্ছে। মানুষের কি কিছু বাদ আছে? বিয়েবাড়ি, পিকনিক, কীর্তন, ভোট, পর্যটন, হোলি, ফাংশন, বাইক রাইড। কিছুই বাদ নেই। 

নমিতার সাথে প্রায় পাঁচ ছয় বার ফোন চালাচালি হল। কিন্তু কেউ কারো কথা শুনতে পারছে না। অগত্যা নমিতাই ওকে ম্যাসেঞ্জারে কল করল। বলল, আসতে হবে না। থেমে গেছে। যাক গে। ল্যাটা চুকেছে। আর যেতে তো চাইছিলই না অরুনাভ। কারণ, ম্যাসেঞ্জারে ওর সাথে আগেই কথা হয়েছে সুতনুর, আজ সময় সুযোগ করে দেখা করবার। সুতনু, পাশের পাড়াতেই থাকে। অরুণাভর বিশ্বস্ত পরকীয়া। বিবাহ বা সংসার ভেঙে সংসার করার বা ঐজাতীয় কোনো শর্ত নেই ওদের ভালোবাসার। শুধু শর্ত একটাই, নির্ভেজাল ভালোবাসা, পরস্পরের জীবনের অভাব অভিযোগের নিরিখে নিজেদের মধ্যে একটা সহায়তায় সহমর্মিতাপূর্ণ ভালোবাসা। যেন দুজন দুজনের সংসার সামলে কিছুক্ষনের জন্য সেই গন্ডি থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে প্রাণখুলে একটু স্বস্তির শান্তির নিশ্বাস নেবে পরস্পরের কাছ থেকে। দূরের পাখিরা যেমন কোথাও এসে মিলিত হয়ে আবার ফিরে যায় আপন কুলায়, সে রকম। তাই সুতনু যখন বলেছে আজ যত রাতই হোক বাড়ির কাজ সামলে ও এসে অরুণাভর সাথে সিটি সেন্টারের পাশের গলিতে দেখা করবেই, কাজেই নমিতার ভূমিকম্পে ভয় পাওয়ার থেকে সুতনুর সাথে দেখা করাটা অনেক বেশি জরুরি আজ ওর কাছে। কিন্তু সুতনু কি সত্যিই আসতে পারবে ওর সাথে দেখা করতে? এই ভাবনাও ক্রমশঃ রাতের অন্ধকারের মতোই গ্রাস করছে ওকে। এই সময় রোজ ইভিনিং ওয়াকে আসে অরুনাভ। ইদানিং মোটা হয়ে যাওয়ায় ওর ফ্যাটি লিভারের সমস্যা কমানোর অন্যতম উপায় হিসেবে অন্ততঃ পাঁচ কিলোমিটার রোজ হাঁটার নিদান দিয়েছেন ডাক্তারবাবু। আর নমিতাও চায় এই সময়টা বাইরে একটু হেঁটে আসুক অরুনাভ। ছেলে মানুষ সারাদিন ঘরে থাকাটাও কেমন বেমানান বলে ও নিজেই ওকে ঠেলে বাইরে পাঠায়। আসলে এই সময়টা নমিতাও পরকীয়ায় মজে থাকে। নানারকম ফোন আসে ওর। কবেকার কোন দাদা, কোথাকার কোন বন্ধু, ভাই, বান্ধবী, বাপের বাড়ি, ফ্লিপকার্ট, কার কার যে ফোন আসে। ছুতা নাতা দিয়ে সেইসব ফোনে মশগুল থাকতে অনেকদিন দেখেছে অরুনাভ। ব্যাপারটা বুঝেও না বোঝার মতো কেমন এক বিকৃত মনের গা সওয়া ব্যাপার হয়ে গেছে ওর যেন আজকাল। আর, অরুণাভরও তাতে বেশ সুবিধাই হয়। এই সময়টা ওও ওর প্যায়ারের লোকের সাথে মন খুলে গল্প করতে পারে, আবার হাঁটাও হয়। আজ সুতনুর সাথে দেখা হওয়াটা খুব জরুরি। কারণ, অরুণাভর মনের ভেতরে আজ কেন যেন সুপ্রচুর হাহাকার, একাকীত্ব, হতাশা সব একসাথে বাসা বেঁধেছে। একদিকে করোনা, একদিকে ভোট, একদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, একদিকে বেকারত্ব, ধর্ম , অধর্ম, হিংসা, খুন, একটা অস্থির সময়ে বাড়িতেও নমিতার সাথে তার ঠিক বনিবনা হচ্ছে না। নমিতার সাথে একটা মানসিক দূরত্বের ব্যথার মলম হয়ে ওঠা সুতনু ওর এখন বেঁচে থাকার একটা অন্যতম অবলম্বনও। তাই এসময় সুতনুর মিষ্টি নরম হাতের ছোঁয়ায়, মুখোমুখি কিছুক্ষনের কথায় এবং ভালোবাসায় একটা মুক্তির বাতাস পাওয়া যেত। কিন্তু সুতনুর সাথেও আর যোগাযোগ হয়ে উঠছে না । কেন? কি হল আবার? কোনো সমস্যায় পড়লো নাকি সেও। 

রাত ক্রমে বাড়তে থাকে, অরুনাভর হাঁটার গতি ক্রমে শ্লথ হয়ে পড়ে। তাহলে চিরকালের মতো আজকেও ধোঁকা দিল সুতনু? রোজই দেখা করবে বলে । কিছু একটা ছুতা দিয়ে আর আসে না। আজ না আসলে ও সিউর হয়ে যাবে যে ওকে খেলাচ্ছে সুতনু। আসলে সেও ওই গতানুগতিক। ভালোই বাসেনা ওকে। শুধু ম্যাসেঞ্জারে প্রেমের অভিনয় করে যায়। আজ ফাইনালি ডিসিশন নিয়েই নেবে অরুনাভ। ইসপার নয় উসপার। ভালো বাসবে না তাও ভালো কিন্তু কোনো নারীর ছলনায় আর ভুলবে না। শেষ পর্যন্ত হলোও তাই। দশটার দিকে ম্যাসেজ এল । স্যরি, কিছু মনে কোরো না, বাড়িতে লোক এসেছিল। আবার দেখা করার চেষ্টা করব কোনোদিন। রিপ্লাই দিল না অরুনাভ। শুধু ক্লান্ত বিষণ্ণ মনে ক্রমে ধীর পায়ে বাড়ির দিকেই পা বাড়ায় সে, আরেকটা নিরামিষ রাত কাটাবে বলে।


শংকর ব্রহ্ম

 


 



গুরুদক্ষিণা

শংকর ব্রহ্ম

------------------------------

 

সেবার তিলজলায়,হতদরিদ্র ছেলেমেয়েদের এক প্রাথমিক স্কুলে পড়াতে গেছি।সেখানে পড়াশুনার চেয়ে স্কুলে এসে গুলতানি করাটাই ছেলেমেয়েদের মূখ্য কাজ।বাবা মা সকালে লোকের বাড়ি কাজে বেরিয়ে যায়।তা'রা ছেলেমেয়েদের এই ভেবে স্কুলে পাঠায় যে সারাদিন পথে পথে ঘুরে বেড়াবার চেয়ে স্কুলে গিয়ে খানিকটা নিরাপদে থাকবে,পড়াশুনা হোক বা না হোক।

      আমি একদিন টিফিনের পর ক্লাস নিতে গিয়ে শুনি,সকলেরই কিছু না কিছু চুরি গেছে ব্যাগ থেকে। কারও খাতা,কারও বই,কারও পেন্সিল, কারও রাবার, কারও বা টিফিনবাক্স থেকে খাবার।কে চুরি করতে পারে সকলেই জানে, কিন্তু হাতেনাতে কোনদিন তাকে ধরতে পারেনি কেউ।শুধু আজ নয়,প্রায়ই এ'ধরণের চুরি হয়।

ক্লাস শেষ হলে,আমি গোপনে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নামটা জেনে নিই। নামটা ধরুন তার সাবির খান।

পরদিন আমি তাকে ডেকে ক্লাসের মণিটার করে দিই।আর বলি, কেউ যদি ক্লাসে দুষ্টুমি করে, তাহলে তার নাম বোর্ডে লিখে রাখবি।আর বলি,এখন থেকে ক্লাসে কারও কোন জিনিষ চুরি না হয়,সে'সব দেখার দায়িত্বও তোর।কারও কিছু চুরি হলে আমি তোকে ধরবো।এই দায়িত্ব পেয়ে সে যেমন একদিকে গর্বিত হয়,অন্যদিকে পড়ে যায় ফাঁপরে।গর্বিত হওয়ার কারণ,এতোটা তাকে আর কেউ কোনদিন মূল্য দেয়নি, সবার উপরে সর্দারী করার। আর ফাঁপরে পড়ার কারণ,নাম লিখবে কি করে সে, তার যে একেবারে অক্ষর জ্ঞান নেই। ক অক্ষর গো- মাংস যাকে বলে প্রবাদে,সে একেবারে তাই।

আমি তাকে সাহস দিয়ে বলি,এ আর কি কঠিন কাজ। শিখে নিবি,তোর যা বুদ্ধি তা'তে শিখতে বেশী দিন লাগবে না।

সত্যি সত্যিই কিছুদিনের মধ্যে সে ক্লাসের চল্লিশ জনের নাম লেখা শিখে ফেলে।ধীরে ধীরে পড়াশুনায়ও তার উন্নতি দেখা যায়। তারচেয়েও বড় কথা ক্লাস থেকে চুরি বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে।তারপর সে সাফল্যের সাথে ক্লাস ফোর পাশ করে, অন্য স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়।

এ'সব দশ বার বছর আগের কথা।

একদিন ধর্মতলা থেকে ৩৯ নম্বর বাসে করে তিলজলার স্কুলে ফিরছি,বাসের টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি,পকেটের পঞ্চাশ টাকার নোটটি হাওয়া, পকেট মার হয়ে গেছে।বারবার পকেটে খুঁজি, আমার চারপাশে,পায়ের কাছে এদিক সেদিক খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ি।নিজেকে কেমন অসহায় লাগে।

ঠিক সে সময়ই একটি লম্বা চওড়া ছেলে,আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে,স্যার কেমন আছেন? আমায় চিনতে পারছেন, আমি সাবির,আমার কথা আপনার মনে নেই?  

মনে পড়ে যায় তার কথা। বলি,হ্যাঁ পারছি,মনে আছে।কেমন আছ তুমি?

ভাল আছি স্যার, বলেই অতো লোকের মধ্যে বাসে ঢিপ করে আমাকে একটা প্রণাম করে,আমি তাকে তুলে ধরে বলি, এ কিরছ?

সে অমায়িক হেসে বলে,কি হয়েছে স্যার, আপনাকে এমন উৎভ্রান্ত দেখাচ্ছে কেন?

আমি তাকে বলি,পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোটটি গায়েব হয়ে যাওয়ার কথা।

সে বলে,তাই নাকি?

দেখুন তো স্যার আপনার পায়ের কাছে ওটা কি পড়ে আছে দেখুন তো?

আমি নীচু হয়ে ঝুঁকে দেখি,হ্যাঁ পঞ্চাশ টাকার নোটটিই পড়ে আছে।প্রাণে জল আসে।

আমি টাকাটি তুলে নিয়ে কন্ডাকটারের কাছ থেকে পাঁচ টাকার টিকিট কাটি।

আমি সাবিরকে খুশি হয়ে বলি,একদিন স্কুলে এসে দেখা করো।

সময় পেলে যা্ব স্যার।সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার,বলে আপনি ভাল থাকবেন স্যার।

আচ্ছা, বলে আমি বাস থেকে নেমে পড়ি তিলজলা স্টপেজে।

  স্কুলে এসে সবাইকে ঘটনাটা বলতেই, সকলে,বলে ওঠে,আপনি স্যার জানেন না?

- কি?

- ও তো এখন পকেটমারের লিডার হয়েছে?

- তাই নাকি? আমি আকাশ থেকে পড়ি।

তবে ও কি আমাকে গুরুদক্ষিণা দিয়ে গেল?


সাবিত্রী দাস



 

 জয় 

সাবিত্রী দাস      

 

আমি আর  আমার  মা, এই দুজনকে নিয়েই সেসময় আবর্তিত  হতো আমাদের  ছোট্ট  পৃথিবী টা। বাবাকে কর্মসূত্রে  দিল্লি তে থাকতে হতো।ইচ্ছে  থাকলেও বছরে দু তিনবারের বেশী  তিনি আসতে পারতেন না।বাড়ীতে ঠাকুমা থাকলেও তিনি ঠাকুরের পূজাপাঠ ইত্যাদি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। বিশেষ করে  ঠাকুরদার আকস্মিক  মৃত্যু  তাকে সংসার  সম্পর্কে নিস্পৃহ করে তুলেছিল। সেই  নিস্পৃহতা  দিন দিন  বাড়ছিল বৈ কমছিল না। সংসারের   ভালো মন্দ কোন কিছুতেই তার কোনরকম আগ্রহ  ছিল না বললেই চলে। 

আমি ছোট থেকেই বড়ো দুর্বল ছিলাম বলে নাকি জানি না  গান শুনতে অসম্ভব  ভালো  বাসতাম।  আমার  বাবা নাকি সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। ঠাকুরদার অকাল  প্রয়াণ তার অনুরাগের বিষয়টি হতে দূরে সরে যেতে  বাধ্য  করেছিল। অল্প বয়সেই সংসারের হাল  ধরতে  বাধ্য হয়ে ছিলেন তিনি। 

  গানের প্রতি অনুরাগ টুকু বাবার কাছ  হতে পাওয়া বললেই চলে।  আগেই বলেছি মাকে  ঘিরে  আমার  জীবন  আবর্তিত  হতো, মা সংক্রান্ত গান শুনতে আমার  খুব ভালো লাগতো। বিশেষ করে " মধুর আমার  মায়ের হাসি  চাঁদের বুকে ঝরে ।"গানটি  আমার  বড়োই প্রিয় ছিল। একটা ঘটনার কথা  বলি। 

সেদিনের কথা আমার আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। সেদিন "মধুর আমার মায়ের হাসি" কথাটির তাৎপর্য  না বুঝলেও বুঝেছিলাম মা সেদিন দারুন আনন্দ পেয়ে ছিলেন।সেই আনন্দের দিনে মা কেঁদে ফেলেছিলেন আমাকে জড়িয়ে ধরে।মায়ের মুখে সেদিন এক অদ্ভুত এক হাসি দেখেছিলাম।সেই হাসির  তাৎপর্য যদিও তখন বুঝতে  পারি নি। বুঝেছি অনেক পরে,বড়ো হয়ে।

 

            ছোটো থেকেই স্বাস্থ্য আমার যে খুব একটা খারাপ ছিল তা নয়।পর পর দুবার কঠিন অসুখে ভুগে শরীর আমার দুর্বল হয়ে পড়েছিল।কি কি অসুখ হয়েছিল তা এখন আর মনে পড়ে না।

  দুর্বলতার কারণে আমাকে যেন সবসময় একটু আগলে আগলেই রাখা হতো।পড়াশোনা ভালোভাবে করলেও খেলাধূলা করার কথায় আমি ভাবতাম আমি ওসব পারবো না।দোতলার ব্যালকনিতে বসে বসে দেখতাম সব বাচ্চারা কেমন খেলছে।কখনো কখনো আমাকে শুকনো মুখে বসে থাকতে দেখে মা খুব দুঃখ পেতেন। কখনো কখনো মা আমাকে পার্কে নিয়ে  যেতেন। আমি  অন্য বাচ্চা দের খেলা দেখতে দেখতে  মায়ের  সঙ্গে গল্প করতাম। আমি  কোনোদিন  খেলতে পারবো কিনা জিজ্ঞাসা  করে  ফেললে  মায়ের মুখখানি করুণ হয়ে উঠতো।এমনি করে দিনগুলো কাটছিলো।

   আমাদের স্কুলে একজন নুতন মাস্টার মশায় এলেন ।খেলা ধুলার শিক্ষক তিনি।আমার কথাও শুনেছেন ।একদিন আমাকে বললেন মাকে কিছু বলতে চান।মা স্কুলে এলে তিনি আমার সম্পর্কে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করলেন। আমাকে  কিভাবে ও কেমন খাবার দিতে হবে মাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন।আমাকে তিনি আলাদাভাবে একটু একটু করে খেলার মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন।আমিও মনের দুর্বলতা  ঝেড়ে  ফেলতে আপ্রাণ  চেষ্টা করছিলাম। মাষ্টার মশায়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায়, সুশৃঙ্খল তত্ত্বাবধানে 

ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। 

   তারপর এলো সেই  বহু প্রতীক্ষিত দিন।আমাদের সেদিন বাৎসরিক খেলাধুলা।তাড়াতাড়ি কাজ সেরে মা ও আমার সঙ্গে খেলার মাঠে গেলেন।

আমার নাম ছিল অংক -দৌড় এ।আমি দৌড় শুরু করলাম।আমার আগে তিনজন দৌড়ে এগিয়ে গেছে।তারপর মাঝে পেতে রাখা কাগজে অংক করলাম।  সাধারন যোগের অংক!মাস্টার মশায় বলেছেন,তাড়াহুড়ো না করতে।তাই অংক করলাম মাথা স্থির রেখে।যদিও মনে আমার একটা উত্তেজনা তো ছিলই।অনেকদিন পর খেলায় অংশ নিতে পারার জন্য।অংকের কাজ সেরে  আবার দৌড়!আমি  তখন দু নম্বরে দৌড়াচ্ছি।দুনম্বরেই গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম।যাক দ্বিতীয় তো হয়েছি।

খেলার শেষে নাম ঘোষণা হলো, শুনলাম আমি  প্ৰথম হয়েছি।যে প্রথমে পৌঁছেছিল তার অংক ভুল হয়েছিল।

পুরস্কার নিয়ে দেখি মা আমার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছেন, মায়ের দুচোখে তখন জল।আমাকে বুকে জড়িয়ে  আদর করলেন।মায়ের মুখে এক অদ্ভুত হাসি।সে হাসি জয় গৌরবের।


শিখা মালিক



 
জাতিস্মর                            

শিখা মালিক                              

 

দশ বছরের মেয়েটা নদীর  ঘাটে নৌকার জন্য  অপেক্ষা  করছে,দেখে মনে হয় শহরের কোন সম্ভ্রান্ত  বংশের  মেয়ে  ,নদীর  ঘাটে আরো লোকজন আছে কিন্তু  কেউ তাকে চেনে না।ষাটোর্ধ পরাণ মাঝি নৌকা নিয়ে হাজির ,অচেনা একলা মেয়ে কে দেখে জিজ্ঞাসা  করে 'যাবে কই খোকি'?তান্না ডেকে উঠলো -পরান কাকা কেমন আছো?পরাণ মাঝি তাকায় মুখ পানে ,বালিকা বলে 'আমায় চিনতে পারো নি?'আমি রায় বাড়ির বউমনি' মাঝি বুঝতে পারেনা কে এই মেয়ে! চিনলো কি করে,রায় বাড়ির বউ মনি! রায় বাড়ি যে দশ বছর আগে শ্মশান হয়ে গেছে,স্মৃতি  হাতড়ায় পরান মাঝি ।তখন বাংলা  জুড়ে  চলছে  দাঙ্গা ,সন্ধ্যাবেলায় সৌদামিনী  চার মাসের শিশু পুত্রকে ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত ,দেউড়িতে শ্বশুরমশাই যতীন্দ্রমোহন  আর সৌদামিনীর স্বামী  শচীন্দ্রনাথ  ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ত ,হঠাৎ  দাঙ্গা বাজদের আক্রমণে  তটস্থ শচীন্দ্রনাথ বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করে স্ত্রী কে বলে খোকা কে নিয়ে খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে যাও সৌদামিনী  বলে -'তোমরা'?শচীন্দ্রনাথ  বলে তুমি যাও পরান কাকার নৌকা  করে নদী পেরিয়ে দূরে চলে যাও ।খোকা কে কোলে নিয়ে সৌদামিনী ঝড়ের বেগে চললো নদীর  কাছাকাছি দাঙ্গাবাজ রা ওকে ঘিরে ধরলো ,কোলের শিশুকে নিল কেড়ে,একজন শাড়ীর আঁচল ধরে মারলো টান ,নারকীয়  উল্লাসে মাতলো হায়নার দল ,তীব্র  আর্তনাদ  শুনতে পেয়ে পরান মাঝি নৌকা  নিয়ে পাড়ে এসে ভিড়লো ততক্ষণে  সব শেষ ।দৌড়ে  গেছে পরান মাঝি রায় বাড়িতে - ধ্বংস লীলার মাঝে পড়ে আছে দুটো রক্তাক্ত  মৃতদেহ ,একটা খেলনা রক্তে  মাখামাখি ।পরাণ মাঝি  অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে  বলে-একি করলে উপরওয়ালা কর্তাবাবুর পরিবার কে এমন করে ধ্বংস  করে দিলে ।তান্না ক্রমাগত  জিজ্ঞাসা করতে থাকে তার ছেলে কেমন আছে তার শ্বশুরমশাই ,স্বামী  তারা কেমন আছে?প্রশ্ন বানে জর্জরিত  পরান কাকা ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে  তাকায় আর ভাবে -কেন জাতিস্মর  হয়ে এলি মা ,তুই বাঁচবি কি করে!



জেবুননেসা হেলেন


 



 

প্রেসার

জেবুননেসা হেলেন

 

খুব গরম পড়েছে।ঘাম শরীর চুইয়ে বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছে।এপাশ ওপাশ করে রীতা উঠে বসলো।ঘুম আসছে না আজও।কি এক শূন্যতায় ছাওয়া চারপাশ।ঘাড়ে হাত দিয়ে দেখে ভিজে ঘাম নুনজল গড়িয়ে পড়ছে পিঠ বেয়ে শিরদাঁড়া বরাবর।বিরক্তিকর শিরশির একটা অনূভুতি ঝাঁকুনি  দিয়ে মনে করিয়ে দিলো সেই স্বাভাবিক সময়ের দিনটির কথা।

নদীর ধারে সে আর নোমান বসে লঞ্চঘাটের দৃশ্য দেখছিলো।একটা যায় নোঙর তুলে,একটা আসে নোঙর ফেলে।

ভেঁপু বাজে... 

ওরা বেড়াতে এসেছে।বসে বসেই নদীর মিষ্টি হাওয়ায় সন্ধ্যা রাতের গভীরে ঢুকে গেলো। কত বছর পর সব পেছনে ফেলে ওরা বেড়াতে  এসেছে! মনে করতে পারে না।

কেমন যেনো মাটির একটা সোঁদা গন্ধ মাতাল করে রাখে বসে থাকা মাটিতেই।কেউ কিছু বলছিলো না তেমন।দু'জনই  দৃশ্যাবলীতে বিলীন।যেন সদ্য কুমার কুমারী। 

বয়সের কথা ভুলে বসে ছিলো ওরা একে অন্যের গা ঘেঁষে।

 

এদিকে লোকজনের চলাচল কম।সাধারণত এমন নিবিড় হবার মত জায়গা চোখে পড়ে না কোথাও।পেছনে ফুলহীন কাশের ঘাস।সামনে দূরে লঞ্চঘাট আর নদীর বয়ে যাওয়া স্রোত। 

একটু যেন ঠাণ্ডা লাগছে। আঁচলটা টানতে গিয়ে রীতার মনে হলো শীরদাঁড়া বেয়ে কিছু একটা উঠে আসছে ব্লাউজের ভেতরে।শিরশিরে বিরক্তিকর আর আতংকিত একটা অনুভূতি। নোমানের হাত চেপে ধরে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলে উঠলো," উফ! কি যেন পিঠে ঢুকে গেছে!সাপ নয়তো?"

এক মূহুর্ত দেরী না করে নোমান হাত ঢুকিয়ে দিলো ব্লাউজ গলিয়ে পিঠের মধ্যে।

একটা বেশ বড় গোবরে পোকা মুঠ করে ধরে সামনে খুলে হেসে উঠে বললো,"যাহ! সামান্য পোকা।ভীতু কোথাকার সাপ আসবে কোথা থেকে?" হো হো হা হা করে হেসে হাঁটতে থাকলো ওর কোমর জড়িয়ে।

লোকালয়ে এসে কোমর ছেড়ে হাত ধরলো। 

টং দোকানে বসে অনেক লোকের মধ্যে চা খেলো।এরপর মোবাইল অন করে বাসার খবর নিলো। বেশ রাতে বাসায় ফিরলো দু'জন।

বড় মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে।ছোট মেয়ের এইচ এস সি পরীক্ষা  সামনে, হয়ত পড়ছিলো।দরজা খুলে দিলো।মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো," মা! তোমাকে কিশোরী কিশোরী লাগছে। তাই না বাবা?" নোমান হেসে আড়চোখে রীতার দিকে তাকিয়ে বললো," তাই তো!”

তিন মাস সবাই কোয়ারেন্টাইনে আছে।কিন্তু নোমান ছুটি পায় নি।ডাক্তারদের ছুটি নেই।করোনা গোটা বিশ্বকে বদলে দিচ্ছে। রীতা নোমান দু' জনই পরোপকারী। রীতা একদিনও নোমানকে তার দায়িত্ব পালনে বাঁধা দেয় নি।

 

রীতা উঠে লাইট জ্বালিয়ে ডিপফ্রিজের ওপর থেকে টিস্যু নিলো।ঘাড়গলা মুছে,বেসিনের কল থেকে চোখে মুখে পানি দিলো।

ডাইনিংয়ে এসে টেবিল থেকে দুই গ্লাস পানি খেলো।নিজেই বুঝতে পারলো,প্রেসারটা হাই।কিন্তু ইচ্ছে করছে না মেশিনটা বের করে প্রেসার মাপতে বা মেয়েদের ডাকতে।কোনো ওষুধ পথ্যও মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না।

ড্রয়িং রুমে ঢুকে লাইট জ্বালালো।এসি ছাড়লো।ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিতেই দেয়ালে পারিবারিক ছবিটায় চোখ পড়লো।বুকের অতল তল থেকে দীর্ঘ এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। শরীর ঘেমে উঠছে আরো। আজ পাঁচদিন নোমান কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে ওদের ছেড়ে চলে গেছে।রাত গভীর হচ্ছে,

রীতার ঘাম বেড়েই চলেছে…


জয়িতা ভট্টাচার্য


 


গোধূলিয়ার পথে

জয়িতা ভট্টাচার্য 

 

তৃণাঞ্জনের ঘুম ভেঙে যায় মধুর মূর্চ্ছনায়। ভোরের মঙ্গলাচারণ শুরু হলো। অন্যদিকে  মসজিদে আজানের ধ্বনি। হালকা শীত।চাদরটা গায়ে জড়িয়ে ব্যালকনিতে এলেই কুয়াশার কাঁচ ভেদ করে চোখে পড়ে প্রবাহিত গঙ্গা। উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁর গঙ্গা,ত্রৈলঙ্গস্বামীর গঙ্গা, বাবার  প্রিয় গঙ্গা,তার.. তৃণাঞ্জনের গঙ্গা ...

বারবার এই প্রাচীন শহর হাতছানি দেয়।

হালকা সাদা উঁকি দিচ্ছে চুলে চল্লিশ পার তৃণাঞ্জনের।

 এবার আসা ভিন্ন কারনে।

 বাবার কাজ করতে এখানে আসা বাবার ইচ্ছে মেনে।

বাবা খুব রাশভারি ছিলেন।আবেগ নেই।নিরাসক্ত যেন লৌহমানব।কিন্তু শেষ দিকে গভীর এক অবসাদে ভুগতেন।

আসতে চাইতেন বেনারসে বারবার।শয্যাশায়ী বাবা নির্নিমেষ জানলার বাইরে খাড়া নিমগাছটা দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন মনে করার চেষ্টা করতেন।

নীরবে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত।

মাকে তার মনে পড়ে না।

গ্রামের মেয়ে  লেখাপড়াও তেমন জানতেন না।সবই শোনা কথা বাবার মুখে।বাবা সেই সব গ্রাম আর মানুষ পরিত্যাগ করে শহরে চলে আসেন।

ব্যস্ত বাবা দিল্লি মুম্বাই লণ্ডন ...তার সঙ্গী  কাদু পিসী। ঠাকুমা,হোস্টেল,বন্ধু, বাবার কন্ঠ আর  ...গঙ্গার নানা পাড় উজানে উজানে।

তৃণাঞ্জনের জীবন সাদামাটা বড়োসড়ো ডিগ্রিসহ।পড়াশোনা করতে হবে আর পৌঁছাতে হবে সর্বোচ্চ শিখরে। মনের ভেতর খড়পোরা তোতাপাখি।তার মধ্যেই ভাগীরথীর জোয়ার ভাঁটার মত বনানী তার জীবনে।এসেছে চলেও গেছে।

বনানী অবশ্য ভালো আছে তার পুত্র কে নিয়ে।এই সচেতন বিচ্ছেদে। তৃণাঞ্জনের সামনে শুধুই  জল আর ঢেউ এখন।

ভিড় হচ্ছে মানুষের। ধর্মভীরু মানুষ। 

কী দেবে গঙ্গা? শান্তি? তবুও শান্তি... নদী হাতছানি দেয়।

আহ্বান করে বাবার কাজ।মন কেমন করে তার। ছেলেমানুষ যেন। দীপ ভাসিয়ে দেয়  প্রতিবার।কার জন্য তা জানে না তৃণাঞ্জন। 

কেন আসে জানে না সে এখানে এই গঙ্গার পাড়।

গোধূলিয়া মোড় রূপ পাল্টে ফেলে। মানুষের ধর্মবুদ্ধির পরিসর ছোটো হতে দেখে। তার মাথায় টার্গেট, তার মাথায়  সাফল্য কর্পোরেটের।

মা। একটা অস্পষ্ট অনুভূতি র নাম।শুধু এখানে এলেই... সন্ধারতির মতো স্মৃতি ভেসে ভেসে যায়  কত কত দীপ জ্বল জ্বল করে ভেসে যায় দিগন্তের দিকে।

আজ,  গোধূলিয়া মজেছে রঙে রঙে। অনেক আলো। দেওয়ালি আসছে।  বনানীর সঙ্গে  সম্বন্ধ বাবা করেছিলেন। প্রেম নিয়ে সে কখনো ভাবার সময় পায়নি।বাবাই সব। একের পর এক পাশ আর একের পর এক প্রমোশন। এর মধ্যে বনানীর সত্যি কোথাও কি জায়গা ছিল? এখন মনে হয় বোধহয় কেউ থাকলে ভালো হতো,পাশে।

দূরে মনিকর্নিকা। আগুন জ্বলছে। বিকেল পড়ে আসছে।

লাল লাল আকাশ। আরতি বিশ্বনাথ মন্দিরে, সরু গলি,প্যারার দোকান ,রং বেরঙের চুড়ি। ভিড়। 

সামনে শিরা ওঠা হাত। নরুণ পাড় শাড়ি। কোঁচকানো চামড়া অসহায় দুটি চোখ।

তৃণাঞ্জন ফেরায় না তাকে। রোজ আসেন এই বিকেলে।

ঘর বাড়ি নেই হয়ত। পথের পাশেই বসে থাকেন।

বাবার কথা মনে হয়।

বাবা তার আইকন।সিংহরাশি। তৃণাঞ্জনের মধ্যে একটা হেরে যাওয়া ব্যাপার আছে। গ্ল্যামারহীন। বাবা ছিলেন ইম্প্রেসিভ।স্মার্ট। 

এত সিঁদুর জলে আজ।এত অস্তগামী আলো...সামনে শিরা ওঠা হাত।

আজ পাশে বসে দেখছে বৃদ্ধা তাকেই। অস্বস্তি হয় তৃণাঞ্জনের।

"তোমার বুকে লাল তিল, বাছা"

ওহ,  হ্যাঁ  মা __ তৃণাঞ্জনের অস্বস্তি হয়।

তোমার পিঠে জরুল আর পেটে কি এমন লাল টুকটুকে একটা আঁচিল আছে?"

তৃণাঞ্জনের অস্বস্তি ছাড়িয়ে বিস্ময় বিস্তৃত হয় চোখে মুখে।

হঠাৎ  মৃদঙ্গের ধ্বনি দ্রুত। আরতি শেষ হবে।

-" বলো না বাবা " আকুতির জবাবে কোনওক্রমে ঘাড়  হেলায় তৃণাঞ্জন।

লালচে আলো বেয়ে চোখের জল নামছে তাঁর গাল বেয়ে। কাঁপা হাতে ছেঁড়া কাপড়ের ঝোলা থেকে দুটি হলদেটে ছবি ।চমকে ওঠে তৃণাঞ্জন।

ঋতু বদলে গেছে।গঙ্গা মায়ের আরতির জোগাড় আর পুজোর ঘাটে একসময় বসে থাকা এক ভিখারিনি সবিতার জীবনে আরো কিছু বাকি ছিল তা গোধূলিয়ার পথ জানত। জানত হয়ত দেবতার চোখ।

তাই একদিন আশ্চর্য চলচ্চিত্রের মত এক ছেলে খুঁজে পায় তার হারিয়ে ফেলা মা কে।

সেদিন গঙ্গায় অনেক ঢেউ,আকাশে নক্ষত্র জ্বল জ্বল করে।

সেদিন আরো জীবন্ত হয়ে ওঠে পাথরের দেব।

জীবন নাটকের চেয়ে কখনও আরো নাটকীয়। কখনো জীবন শেষে এসে ফুল ফুটিয়ে যায় নীরবে।

সবিতা আঁকড়ে ধরে  তৃণাঞ্জনের বুক।পলকা শরীর অসহায় এক নারী।

আরো প্রবাহ। আবহমান চলতেই থাকে সময়।

আট বছর পরের একটি দিন।গঙ্গা প্রবাহিনী আজও সেদিনের মত। তৃণাঞ্জনের পাতলা চুলে শুভ্রতা। আরো একটু বদলে গেছে দিন বদলে গেছে  চশমার লেন্স।বারবার ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি। বারবার  চোখ মুছে আবার মন্ত্র পড়ে সে।মা ।তার মা চলে গেছেন তারা হয়ে।

ঘাটে সাজানো দান সামগ্রী, পিণ্ডদান ,পাখি মুক্তি পায়। 

মনের শান্তি।তৃণাঞ্জনের বুকে মোচড় দেয় কান্না।

আরো কত মা ,প্রতারিত মা , বিতারিত মা এই গরিব দেশে আজও  ভিখারিনি প্রতিটা মন্দিরে মসজিদের অপর পাড়ে বসে আছেন।

তার দুঃখিনী মার মত। 

কালো রং, উচ্চ  শিক্ষা আর সফিস্টিকেসনবিহীন মা... যাকে বাবা ঝোঁকের বসে বিয়ে করেছিলেন আর তারপর ফেলেও দিয়েছেন ।

এমনকি সন্তানকেও কেড়ে নিয়ে ফেলে চলে গেছেন একদিন বিপাকে।

মা কে উদ্ধার করে সব সুখটুকু  উজাড় করে দিতে দিতে পলকে  এই আট বছর....।

এই আট বছরে মা কে নিয়ে কত তীর্থে, কত আনন্দে,দামি শুশ্রুষা আর ভালোবাসায় কেটে গেছে স্বপ্নের মত।

মা র কাছে শুয়ে তৃণাঞ্জনের চোখ বারবার  তাকিয়ে থেকেছে বাবার ছবির দিকে।

নতুন চোখে আবিষ্কার,  নতুন করে এক ইস্পাত কঠিন আদ্যন্ত  অভিনেতা বাবাকে আবিষ্কার। মা কখনো নালিশ করেননি তবু।শুধুই বালিকার মত তৃণাঞ্জনকে আঁকড়ে ধরে নীরব মা। 

এখন সব চাওয়া পাওয়ার উর্দ্ধে মা। হাওয়া দিচ্ছে। 

ঢেউ...

একটা দীপ টলমল করে চলে যাচ্ছে দূরে। তার থেকে অনেক অনেক দূরে।

তৃণাঞ্জনের   কান্না পাচ্ছে খুব।



 

রতন চন্দ রত্নেশ


 


কর্মব্যস্ত 

রতন চন্দ রত্নেশ 


শহরে এত দাঙ্গা হল কিন্তু আশ্চর্য! ওই পাড়ায় কোনো ঝামেলা হল না, সর্বদা শান্তি অথচ সেখানে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান সবই ধর্মের লোকেরা থাকে। 

কারণ জানার জন্য আমি ওই এলাকায় গেলাম আর সেখানে এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কি কারণ যে যখন দাঙ্গা হয়, এখানে কখনও কোনো গন্ডগোল হয় না?' 

বৃদ্ধ হাসল। বলল, 'সোজা সামান্য কথা ভাই। আমাদের এই এলাকায় কারুর কাছে ধর্ম অথবা ইশ্বর নিয়ে চর্চা কিম্বা তর্ক করার সময় নেই। সব নিজের নিজের কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে।'



 

সোমনাথ বেনিয়া


 

রক্ত / সোমনাথ বেনিয়া


মায়ের অসুখ। রক্তের দরকার। গ্রুপ ও নেগেটিভ। রেয়ার গ্রুপ। সহজে পাওয়া যায় না। হাসপাতালে বললো ডোনার পেলে দেওয়া যাবে। স্টকে আছে। এখন ডোনার কোথায় পাই! চেনা-পরিচিতদের মধ্যে খবর রটতে পাশের বাড়ির জুলি বউদি এগিয়ে এলো। বউদি বললো, "আমার ও নেগেটিভ। আমাকে নিয়ে চলো।" আমি ইতস্ততবোধ করি। তবুও নিয়ে যাই মায়ের মুখ মনে পড়ায়। ব্লাড ডোনেট করার পর বউদি জিজ্ঞাসা করলো, "তোমার রক্তের গ্রুপ কী?" বললাম, "বি পজেটিভ।" এরপর দু-জনে হাসপাতালের বাইরে একটা চায়ের দোকানে যাই। চা শেষ করে বউদি যখন একটা সিগারেট ধরালো তখন আমার চোখে-মুখে বিব্রতভাব ফুটে উঠলো। তা বউদি লক্ষ্য করে বললো, "এটা ঠিক যে সংসার চালানোর জন্য আমি অন্ধকার গলিতে দাঁড়াই। তবে রক্ত পরিষ্কার। নিশ্চিন্তে থাকো। চললাম। দরকার পড়লে আবার ডেকো।" বউদি হাঁটা দিলো আর তার মুখে ধরা সিগারেটে আগুন হয়ে জ্বলছে আমার বি পজেটিভ ...


(লেখাটি সম্পূর্ণভাবে মৌলিক এবং অপ্রকাশিত)



 


 

বুধবার, ৫ মে, ২০২১

তাপসকিরণ রায়


 

 

সখী, ভালোবাসা কারে কয়?

তাপসকিরণ রায়

 

অরুণা ডুবে যাচ্ছিল। সে দু-তিনবার চিৎকার দিয়েছিল, বাঁচাও, বাঁচাও--তারপর তার দুটো হাত দু’বার জলের ওপর ভেসে উঠতে দেখা গেল। সরলের কানে সে চিৎকার এসে পৌঁছে ছিল। সে দেখছিল, অরুণার শেষ আকুতিপূর্ণ দু’টি হাত জলের উপর ভেসে আছে। এত কিছুর পরও সরল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল। সে অরুণার চিৎকার শুনেও শুনতে পেলো না, তার তলিয়ে যাওয়ার আগের দুটো হাত দেখেও দেখতে পেল না। সে তখন উল্টো দিকে মুখ করে আকাশ দেখলো, পাশের ছোট-বড় গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ও যেন সেই মুহূর্তে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। 

*********

অরুণা ও সরল ছোট বেলার সাথী ছিল। প্রাইমারি স্কুল থেকে হাই স্কুল পর্যন্ত এক সাথে ওরা পড়াশোনা করেছে। তারপর অরুণা আর পড়াশোনা করতে পারেনি, সরল চলে গেছে কলকাতার এক কলেজে। ছুটিছাটায় ঘরে আসত সরল। অরুণার সঙ্গে দেখা হত। ওরা দুজনে লোকালয়ের বাইরে নির্জনতায় পাশাপাশি বসে প্রেমালাপ করত। অরুণা গেয়ে উঠতো, সখি ভালোবাসা কারে কয়--সে কি শুধুই যাতনাময় ?

সরল বলত, আমি তো তোমার পাশে আছি, সখি, তবু কেন এত বিরহ তোমার অরুণা বলতো ?

অরুণা বলেছিল, তুমি তো আবার চলে যাবে, তোমায় না পেয়ে আমার দিন কাটে কেমন ভাবে বলতো ?

সে দিন সরল যেন প্রগলভ হয়ে উঠেছিল। ও বলেছিল, তাহলে পার্টটাইম কোন প্রেমিক জুটিয়ে নাও-- 

অরুণা বলেছিল, বাজে বকো না তো তুমি, তুমি বুঝি কলকাতায় প্রেমিকা নিয়ে সময় কাটাও! সেদিন দুজনে মিলে এমনি কথা নিয়ে খুব হেসেছিল।

এই হাসাহাসির বিষয়টা যে একদিন সত্য হয়ে দাঁড়াবে তাকি সরল কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল! 

ছটা মাস সরল বাড়ি আসতে পারেনি। তারপর বাড়ি এসেই শুনতে পেল কথাটা, অরুণা নাকি অন্য প্রেমিকা জুটিয়ে নিয়েছে। কথাটা সরলকে তার বোন জানিয়ে ছিল। বিশ্বাস হয়নি তার, সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল, মনে মনে ভেবে ছিল, তা হতেই পারে না !

একদিন সত্য সামনে এসে দাঁড়াল। সরলের কদিন পর হঠাৎই অরুণার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয়ে গেল । ও বলে উঠলো, অরুণা কি ব্যাপার তুমি আমায় এড়িয়ে যাচ্ছো কেন?

অরুণা খানির চুপ থেকে বলে উঠলো, খুব ব্যস্ত আছি সরল।

সরলের রাগ হয়েছিল খুব। সে বলেছিল, ওই গোবিন্দকে নিয়ে ব্যস্ত আছো তো ?

প্রথমটা রাগত চোখে তাকালো অরুণা, এক সময় শান্ত হয়ে বলল, জানো সরল, গোবিন্দকে আমার ভালো লাগে--সে যে আমায় ভীষণ ভালোবাসে--

--আর তুমি? সরল প্রশ্ন করেছিল।

--আমি ? অরুণা একটু ভেবে নিয়ে সরলের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলে উঠেছিল, আমি এখনো দুই নৌকায় পা দিয়ে রেখেছি গো--

সরলের কথাটা একেবারেই ভালো লাগেনি। সে বলেছিল, তা চলেনা অরুণা, এক জনকে তুমি বেছে নাও--

সরল সত্যিই ভালবেসেছিল অরুণাকে। সে দিন রাতে সে  বিছানায় শুয়ে চোখের জল ফেলে ছিল। ভালোবাসা ত্যাগে, নাকি ভোগে কিংবা ঈর্ষায় প্রকাশ পায় ? জানে না সরল।

সে দিন নদীপারে আনমনে এসে দাঁড়িয়েছিল সরল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, অরুণা ও পাড়ার একটা মেয়ে নদীর ঘাটে স্নান করছে। অনতিদূরে অরুণার প্রেমিক গোবিন্দ দাঁড়িয়েছিল। সে ওদের স্নানের দৃশ্য দেখছে ।

ভীষণ রাগ হচ্ছিল  সরলের। এর মধ্যেই হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেল সেl সে দেখল, অরুণা জলে ডুবে যাচ্ছে, সে চিৎকার করছে, সঙ্গের মেয়েটা ভালো সাঁতার জানে না হবে, চেষ্টা করেও অরুণাকে জল থেকে সে তুলে আনতে পারছে না। মেয়েটার মুখ থেকেও,  বাঁচাও, বাঁচাও, অস্ফুট চিৎকার বেরিয়ে আসছিল। সরল দেখল গোবিন্দ ছুটে নদীর কিনারে গেল কিন্তু ও নদীতে ঝাঁপ দিল না। 

সরল ভালো সাঁতার জানে, সে দেখল, ডুবন্ত অরুণার দুটো হাত ভেসে উঠল জলের ওপর। ব্যাস ওই পর্যন্ত--

সরলের মনে হল বহুদূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসছে--বাঁচার আবেদন-নিবেদনগুলি ভেসে উঠে, আবার ডুবে যাচ্ছে। সরল অন্যদিকে তাকিয়ে আকাশ দেখছিল, দেখছিল, একটা বড় গাছের মাথায় একটা পাখি জোরে জোরে ডানা ঝাপটাচ্ছিল।  

সমাপ্ত